সামনে সেমিষ্টার ফাইনাল। এই মুহুর্তে
পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা ছাড়া একটা মিনিটও সময় নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই অণুর। রাতদিন কেবল বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে সপ্তাহখানেক ধরে। দরজায় কলিং
বেল বাজতেই, তাই সে খানিকটা বিরক্তি
বোধ করলো মনে মনে। এই অসময়ে আবার কে এলো!
বিরামহীন ভাবে বেজেই যাচ্ছে কলিং বেলটা। এবার দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটির ওপর বিরক্তির মাত্রা চরমে
উঠে গেলো একেবারে। কী আজব মানুষ! নূন্যতম
কমন সেন্স বলতেও নেই দেখছি! বেল বাজিয়ে তো মানুষ কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে দরজা খোলার
জন্য। এই মানুষটা শুরু থেকেই পর পর কলিং বেল বাজিয়েই যাচ্ছে। ওপাশের অদেখা মানুষটার ওপর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতে
যায় অণু। সঙ্গে রূঢ় কণ্ঠে দু’টো কথা
শুনিয়ে দেবার মানসিক প্রস্তুতি!
দরজা খুলতেই দেখলো খানিকটা লম্বা অবয়বের একজন লোক দাঁড়িয়ে
আছে। ও ঘর থেকে আসার সময় মনে
মনে দু’কথা শুনিয়ে দেবার মানসিক প্রস্তুতি ভেস্তে গেলো, লোকটার মুখের দিকে
তাকাতেই! কী মায়াবী চাহনি! অপলক দৃষ্টিতে মায়াময় মুখ করে তাকিয়ে আছে অণুর দিকে। চোখের ভাষায় হাজারও
শুন্যতার উপস্থিতি যে কেউ বুঝে নিতে পারবে খুব সহজেই! মুহুর্তেই কী যেন হলো অণুর! সেও খানিক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো লোকটার দিকে। তারপর প্রথম
নীরবতাটুকু ভাঙলো
অণু নিজেই....।
- কে আপনি?
- আদিত্য।
- কোত্থেকে এসেছেন?
আর কাকে খুঁজছেন?
- এসেছি বহুদূর
থেকে। আর যাকে খুঁজছি তার সামনেই এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি!
লোকটার
সাথে অণুর আগে কোনোদিন দেখা হয়নি। তাকে কোনোভাবেই পূর্ব পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না অণুর। সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একজন লোক। অথচ তাকেই খুঁজছে! অণুর
ভাবনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে লোকটা আবার বলতে শুরু করলো…
- চলুন...।
- চলুন মানে? কোথায় যাবো? আর আপনিই বা কে? কেন আমি আপনার সাথে যাবো? ব্যাপারটা
একটু খুলে বলুন তো...?
- প্রথমেই তো বলেছি, আমি আদিত্য। এই মুহুর্তে আমার সাথে আপনি মর্গে যাবেন। এখানে
আর কোন ব্যাপার নেই!
মর্গের
কথা শুনে
মাথাটা
কেমন যেন ভনভন করে ঘুরতে লাগল অণুর। চারিদিকে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে সে। ভীষণ অন্ধকার! আর অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করতে শুরু করে দিলো তার মনের মধ্যে। তাহলে কী পরিচিত কারো কোন...!
নাহ্...কিছুই যেন সে ভাবতে পারছে না আর। গলাটা শুকিয়ে আসছে কেবল। তবুও
কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো…
- মর্গে কেন যেতে হবে?
- কারণ ওখানে মৃত মানুষেরা থাকে তাই।
- তার মানে!
অণুর চোখজুড়ে অন্ধকারের উপস্থিতি বাড়তে লাগলো ধীরে ধীরে। হাত-পা কাঁপছে। তবুও নিজেকে সামলে নেয়ার ভান করে বললো…
- আমার পরিচিত কারো কী….
কথা
শেষ হবার আগেই লোকটা তাকে থামিয়ে দেয়…।
- আপনার পরিচিত কারোই কিছু হয়নি।
কথাটা শুনে
অণু যেন সাহস ফিরে পেলো কিছুটা। সাথে খুব রাগও হলো লোকটার ওপর। এভাবে অপরিচিত মানুষের বাসায় বেল বাজিয়ে অযথা ফাজলামি করার কোন
মানে হয় নাকি! মনে মনে আসা কথাগুলো অণু মুখে বলতে পারলো না লোকটাকে। মৃদু কর্কশ কণ্ঠে শুধু বললো…
- তাহলে আমাকে কেন শুধু শুধু মর্গে যেতে বলছেন?
- কারণ একটু পর আপনি মারা যাবেন।
লোকটা বরাবরই
অণুর প্রশ্নগুলোর উত্তর খুব ধীরস্থির আর শান্ত কণ্ঠে দিচ্ছিলো। এবার সেই শান্ত কণ্ঠে হিমালয় ছোঁয়ার শীতলতা টের পেলো অণু!
মেজাজটা খুব চড়ে গেলো তার। আবারও ফাজলামি করছে
লোকটা।
- আমি মৃত মানুষের
আত্মা। জীবিত অবস্থায় আমার নাম ছিলো আদিত্য।
এবার আর কিছুতেই নিজের
রাগটাকে মনের মধ্যে সামলে রাখতে পারলো না অণু। চেহারায় ফুটে উঠলো
ব্যাপারটা। লোকটাও বুঝতে পারছে, অণু রেগে যাচ্ছে। তবুও সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সে বলেই চলেছে…
- চলুন…। সময় বেশি নেই।
কথাগুলো কানে পৌঁছুতেই
অণু রাগ-ক্ষোভ, চরম বিরক্তি
আর তাচ্ছিল্যের সংমিশ্রনে প্রশ্ন করলো তাকে…
- তা…কিভাবে
মারা গেলেন আপনি?
- ফাঁসিতে ঝুলে।
- তার মানে আপনি
আত্মহত্যা করেছেন?
- হুম।
- কিন্তু কেন?
- তা তো আপনাকে
বলতে পারবো না!
- ওহ্...!
লোকটা বুঝতে
পারলো, অণু তার কথাগুলো মোটেও বিশ্বাস করেনি। মানুষ মরে গেলে তার আত্মা কখনো জীবিত মানুষের সামনে এসে এভাবে
দাঁড়াতে পারে না। জীবিত মানুষের সাথে এমন করে
কথা বলতে পারে না। এসব কেবল গল্পেই সম্ভব। লোকটা সম্ভবত অণুর মনের কথাগুলো
বুঝতে পারলো! তাই বলে উঠলো…
- আপনি বোধহয় আমার কথাগুলো ঠিক বিশ্বাস করলেন না!
- আপনি কি বিশ্বাস করার মতো কিছু বলেছেন এখনও পর্যন্ত?
- ঠিক আছে। যদি প্রমাণ দেই আমি মৃত…
- আচ্ছা…তবে দিন প্রমাণ…।
- আপনি আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করুন। যদি স্পর্শ করতে পারেন তো আমি জীবিত। আর যদি না পারেন, তো আমার কথার প্রমাণ
আপনি তখনই পেয়ে যাবেন।
এতোক্ষণ কথা বলে অণু এতটুকু বুঝতে পেরেছে, লোকটা নাছোড়বান্দা।
যত দ্রুত সম্ভব লোকটার কথাগুলো ভুল প্রমাণিত করে, লোকটাকে বিদায় করা উচিত। তাই ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে লোকটার
দিকে অনিচ্ছাকৃত হাত বাড়ায় সে। কী অবাক কাণ্ড! লোকটা যে জায়গায়
দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে হাত বাড়িয়ে কেবল একটা শীতল অনুভব পেলো
সে! তার সামনে জলজ্যান্ত একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। অথচ সে কিছুতেই তাকে স্পর্শ করতে পারছে
না। নিজেকেই
বিশ্বাস হলো তার! মনে হলো যেন পৃথিবী থেকে অনেক দূরে আছে
সে! পরক্ষণেই ভয়ের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কি করবে কিছুই
বুঝে উঠতে পারছে না। কিছু করে ওঠার আগেই লোকটা দু’হাতে তার মাথাটা প্রচণ্ড জোড়ে চেপে ধরলো। সে চোখ বন্ধ করে তার মাথা থেকে লোকটার হাত ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরাম। চিৎকার করতে করতে
একসময় জ্ঞান হারায় সে…। তারপর আর কিছু মনে
নেই তার!
যখন চোখ খোলে, দেখে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে
সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বিকাল ৪টা ৪৪মি.।
দিনদুপুরে এমন একখানা অবাস্তব স্বপ্ন দেখে সত্যিই
খানিকটা আঁতকে উঠে
অণু! আর পরক্ষণেই আপনা আপনিই বোকা বনে যাওয়ার কথা ভেবে এক টুকরো
শব্দবিহীন হাসি লেগে থাকে তার অধরে!